পানিই জীবন পানিই মরণ । জীব জগতের অস্তিত্বে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে পানি। পানি শুধু আমাদের তৃষ্ণাই মেটায় না, তার সঙ্গে শারীরিক ক্লান্তিও দূর করে। আয়ুর্বেদে পানির নানা গুণের বিবরণ রয়েছে।

পেটের যন্ত্রণা থেকে শুরু করে মাথার যন্ত্রণা সর্বক্ষেত্রেই ওষুধের কাজ করে পানি।

শীতল পানি যেমন তীব্র গরমে আমাদের পিপাসার্ত হৃদয়কে পরিতৃপ্তি দেয়। তেমনি উষ্ণ পানিরও তেমন শক্তি রয়েছে। উষ্ণ পানিতে যদি গোসল করা যায় তাহলে শরীরের সব ক্লান্তিই নিঃশেষ হয়ে যায়। শরীর ও মন স্বতঃস্ফূর্ত হবে। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ উষ্ণ পানিতে গোসল করেই চাঙ্গা থাকে। তাছাড়া বিশ্বের সব দেশেই গরম পানির প্রচলন রয়েছে। তাই আধুনিক চিন্তাধারায় নির্মিত হয়েছে হট বাথটাব। তবে এটি নতুন কোনো ধারণা নয়।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে বাথটাব অর্থাৎ স্নানাগারের অনেক নমুনাই পাওয়া যায়। আপনি যদি কোনো কারণে ক্লান্ত থাকেন, তাহলে গোসল করলেই ফুরফুরে ভাব অনুভব করবেন। পানিই জীবন পানিই মরণ । এক ফোঁটা নোংরা পানিতে পাঁচ কোটিরও বেশি জীবাণু থাকতে পারে। নোংরা পানি পানে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের পেটেরপীড়া, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, কৃমিরোগ, এভাবে অনেকগুলো পানিবাহিত রোগের নাম উল্লেখ করা যাবে। বিষাক্ত পানি পান করে রোগজটিলতায় অনেকে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করতে পারে।

খাদ্য বলতে যা বুঝি,

পানির মধ্যে সেটি নেই। খাদ্য হচ্ছে আমরা যা আহার করি তা পরিপাকতন্ত্রে পরিপাক হয়ে ক্যালোরি উৎপন্ন করে। এই ক্যালোরিই শক্তি। যা আমাদের শরীরকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখে, কর্মক্ষম রাখে, দৈহিক গঠনও বৃদ্ধিসাধন করে। পানির মধ্যে কোনো ক্যালোরি নেই। তাই পানি খাদ্য হতে পারে না। এ বিষয় নিয়ে বিতর্কও আছে। পুষ্টিবিদগণ খাদ্যকে ছয় ভাগে ভাগ করেছেন। শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, মিনারেলস ও পানি। শরীরের তিন ভাগের দুই ভাগই পানি। যে খাদ্য প্রতিদিন আহার করছি মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ভাত, রুটি, শাক-সবজি, ফলমূল, সবার মধ্যেই পানি রয়েছে। চুমুক দিয়ে কেবল পানি পান করছি তাই নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত পানি পান করছি।

জ্ঞানীরা বলেছেন,

‘খাওয়ার ব্যাপারে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ ভরতে হবে খাদ্য দ্বারা, এক-তৃতীয়াংশ পানি দ্বারা এবং অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ রাখতে হবে খালি।’ ‘পরিমাণ করে খাদ্য খাও কিন্তু পরিমাপ করে পানি পান করো না। ‘শুধু খাবারই খেয়ো না তার সঙ্গে পরিমাণমত পানিও পান করো।’ মার্কিন লেখক হেনরি ডেভিড থরো বলেছেন, বিজ্ঞ মানুষ শুধু পানিই পান করেন। হাসপাতালে শরীর ফোলা রোগীদের জন্য পানি পান করতে দেয়া হয় হিসাব করে। যে পরিমাণ প্রস্রাব সারাদিনে হবে সে পরিমাণ পানি পান করবে। কিডনি বিকল রোগীদের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ প্রস্রাব আগের দিন হবে, পরের দিন তার সঙ্গে ৫০০ সিসি বেশি পানি পান করতে দেয়া হয়। প্রথম দিন দেড় থেকে দুই লিটার অর্থাৎ ৬-৮ গ্লাস পানি ধার্য করে দেয়া হয়।

মানবদেহে দুইটি কিডনি রয়েছে।

প্রতিটি কিডনির ওজন ১১৩ থেকে ১৭০ গ্রাম। প্রতিটি কিডনির মধ্যে ছাঁকনি রয়েছে ১০-১২ লাখ। প্রতিদিন কিডনি ৮০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে বর্জ্য প্রস্রাবের মাধ্যমে নির্গমন করছে। একটি কিডনি কোনো কারণে অকেজো হয়ে গেলে অন্যটি একাই মানব শরীরের প্রয়োজন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, শরীরের বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না।

প্রতিদিন গড়ে প্রাপ্তবয়স্ক একজন ব্যক্তি ছয়বারে এক থেকে দেড় লিটার প্রস্রাব করে। পানি বেশি পান করলে প্রস্রাব বেশি হবে, কম পান করা হলে প্রস্রাব কম হবে। রমজান মাসে রোজাদারদের সারা দিনে প্রস্রাবের পরিমাণ আরও কমে যায়।

২৪ ঘণ্টায় ৫০০ সিসির কম প্রস্রাব হলে বলা হয় অলিগুরিয়া। তিন লিটারের বেশি হলে বলা হয় পলিউরিয়া। কিডনির ভিন্ন ভিন্ন রোগের কারণে এমনটি হয়। তখন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা একান্ত প্রয়োজন হয়। কিডনির এমন রোগও আছে যখন একজন রোগীর প্রতিদিন ৫-৬ লিটার প্রস্রাব হয়। তখন তাকে ৫-৬ লিটার পানি পান করানো যায় না বিধায় মুখে পানি খেতে হবে এবং শিরায় স্যালাইন দিতে হবে। উক্ত রোগীর যে পরিমাণ প্রস্রাব হচ্ছে সে পরিমাণ ফ্লুইড দিতে হবে। যার সারা দিনে প্রস্রাব হচ্ছে ৫০০ সিসি, তার পরদিনে পানি খেতে হবে ১০০০ সিসি।

১০০০ সিসি প্রস্রাব হলে পরের দিন ১৫০০ সিসি পানি ধার্য করা হয়। যাদের প্রস্রাবে ইনফেকশন (প্রদাহ) হয়, তাদের পানি বেশি পান করতে বলা হয়। প্রতিদিন ১৫-২০ গ্লাস। আমার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এফআরসিএস, একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, প্রতিদিন ১৫-২০ গ্লাস (৪-৫ লিটার) পানি পান করা হলে ৯৫ ভাগ রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না; প্রস্রাবের সঙ্গে চলে যায়।

ওয়াইডস্টেট ইউনিভার্সিটি ওয়েক্সনার মেডিকেল সেন্টারের বিজ্ঞানী লরিং বলেন, প্রায়ই বলা হয় পানি হল সবচেয়ে পুষ্টি উপাদান। নারীদের জন্য পানি পান করার পরামর্শ দুই থেকে সোয়া দুই লিটার দিনে এবং পুরুষদের জন্য তিন লিটার। অনেকের জন্য এটি বেশি মনে হতে পারে কিন্তু সুস্থ মানুষের জন্য এই পানি পান প্রয়োজন। কিডনি বিকল রোগীদের (সিকেডি) পানি কম খেতে বলা হয়। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়। সেটি নির্ভর করে কিডনির বায়োকেমিক্যাল রিপোর্টের উপরে। কিডনির কার্যক্ষমতা বুঝতে হলে ইউরিন আরএমই এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিন করতে বলা হয়।

এছাড়াও ইউরিয়া এবং ইলেকট্রলাইটস (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লরাইড, বাইকার্বনেট) ইত্যাদি প্যারামিটার করা হয়। কিডনি জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গতন্ত্রের মধ্যে একটি (অন্যগুলো ব্রেইন বা মস্তিষ্ক, হার্ট, লাংস বা ফুসফুস, লিভার) এই পাঁচটি অঙ্গের যে কোনো একটির কার্যক্রম থেমে যাওয়া অর্থই মৃত্যু। কিডনি বিকল রোগীরা প্রতিদিন কী পরিমাণ পানি পান করবেন সেটিই শুধু নয়, কী ধরনের খাদ্য, কী পরিমাণ খেতে হবে সেটিও চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেন। পথ্য চিকিৎসকের চেয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার ত্বরিত করতে পারে।

শিশু যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন তার দেহের ৯৫ ভাগই পানি। জন্মের পর থেকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির পরিমাণ কমতে থাকে। পানির অপর নাম জীবন। শিশুদের ক্ষেত্রে ৭৫-৮০ ভাগ পানি। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে ৬০ ভাগ, মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫৫ ভাগ পানি। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ৫০ ভাগ, বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৪৫ ভাগ পানি।

স্বাস্থ্যকর কিডনির জন্য পাঁচ খাবার

কিডনি দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রক্ত পরিশোধন করে কিডনি দেহের বর্জ্য নিষ্কাশন করে। অস্বাস্থ্যকর খাবার বা পানীয় গ্রহণ করলে কিডনির ক্ষতি হয়। সাধারণ কিছু খাবার রয়েছে, যা নিয়মিত গ্রহণ করলে সুস্থ কিডনি বজায় রাখা সহজ হয়। তেমন কয়েকটি খাবারের কথা তুলে ধরা হল।

১. আপেল, ২. বাঁধা কপি ৩. লাল ক্যাপসিকাম ৪. রসুন ৫. পেঁয়াজ।

আপেল : এটি কোলেস্টেরল কমিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া আপেল কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, যা দেহের বিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী।

বাঁধা কপি : বাঁধাকপিতে ভিটামিন কে, ভিটামিন সি ও প্রচুর ফাইবার রয়েছে। এ ছাড়া এটি ভিটামিন বি ও ফলিক এসিডের জন্য বিখ্যাত। বাঁধা কপির উপাদান শুধু কিডনির জন্য নয়, এটি ক্যান্সার প্রতিরোধেও কার্যকর।

লাল ক্যাপসিকাম : লাল রঙের ক্যাপসিকাম কিডনির জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি খাবার। এটি পটাসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ও ফলিক এসিড এবং ফাইবারের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া এতে রয়েছে লাইকোপেন নামে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট।

রসুন : রসুনের উপাদান দাঁতের প্লাক দূর করতে ভূমিকা রাখে। এটি দেহের কোলেস্টেরল কমাতে ও দেহ ফুলে যাওয়া রোধ করতে কার্যকর। এটি ব্যবহার করে বহু খাবারের স্বাদও বৃদ্ধি করা যায়।

পেঁয়াজ : পেঁয়াজের নানা উপাদান কিডনি সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এতে রয়েছে ফ্লেভনয়েডস। এছাড়া এতে রয়েছে কোয়ারসেটিজ নামে একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর। পেঁয়াজে স্বল্পমাত্রার পটাসিয়াম রয়েছে। পেঁয়াজের ক্রোমিয়াম দেহের কার্বহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিন বিপাকে সহায়তা করে।

পানিই জীবন পানিই মরণ । পানির আরও কিছু উপকারিতা রয়েছে

* এক গ্লাস পানি ঘুমাতে যাওয়ার আগমুহূর্তে পান করলে হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে।

* এক গ্লাস পানি ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পান করলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয় হয়ে যাবে।

* এক গ্লাস পানি যদি আহারের আধা ঘণ্টা আগে পান করেন, তবে এটা খাবার হজমে বেশি সাহায্য করবে।

* এক গ্লাস পানি গোসলের আগমুহূর্তে পান করলে এটা উচ্চ রক্তচাপ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

Source By jugantor.com